




অধ্যাপক আবদুল গফুর ভাষা আন্দোলনের একজন অগ্রসেনানী। তিনি ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের শুরু থেকে সক্রিয় নেতা এবং ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি দেশের





একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখক। পাকিস্তান আন্দোলন ও ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী জাতির এই কৃতী সন্তান অধ্যাপক আবদুল গফুরের সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন দৈনিক ইনকিলাবের সহ-সম্পাদক সৈয়দ ইবনে রহমত। সৈয়দ ইবনে রহমত: স্যার, কেমন আছেন? অধ্যাপক আবদুল





গফুর: আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছি। বয়সের কারণে কিছু সমস্যা তো থাকেই। তবে এখনো চিন্তা করতে পারছি, লিখতে পারছি, এটাই বড় কথা। সৈয়দ ইবনে রহমত: আপনার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন সম্পর্কে যদি আমাদেরকে কিছু বলেন। অধ্যাপক আবদুল গফুর: আমার জন্ম ১৯২৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজবাড়ি জেলার দাদপুর গ্রামে। আব্বা আলহাজ মুনশী হাবিল





উদ্দিন ছিলেন একজন কৃষক। তিনি আমাদের গ্রামে একটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ ছিল। বর্তমানে এটি প্রাইমারি স্কুল। আমি আমার আব্বার প্রতিষ্ঠিত মক্তবে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। তারপর পাবনায় তালিম নগর মাদরাসায় ভর্তি হই। সেখানে পড়েছি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। এরপর ফরিদপুর ময়েজ উদ্দিন হাই মাদরাসায় ভর্তি হই সপ্তম শ্রেণিতে। সেখান থেকেই ১৯৪৫ সালে হাই মাদরাসা ম্যাট্রিকুলেশনের সমমান পরীক্ষায় পাস করি। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করেছিলাম।





আসাম ও বাংলায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় আমার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। সৈয়দ ইবনে রহমত: ঢাকায় এলেন কখন? কোথায় ভর্তি হয়েছিলেন? অধ্যাপক আবদুল গফুর: ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়ে প্রথমে হুগলি কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়া আমার ভালো লাগেনি। কলকারখানার ধোঁয়া আমার সহ্য হয়নি। তাই চলে আসি ঢাকায়। ঢাকায় এসে গভর্নমেন্ট ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হই, এখন যেটা সরকারি কবি নজরুল কলেজ হিসেবে পরিচিত। থাকতাম কলেজের প্যারাডাইস হোস্টেলে। মেধাবী এবং বৃত্তিপ্রাপ্ত স্টুডেন্ট হিসেবে কলেজে আমার টিউশন ফি এবং হোস্টেল ফি মাফ ছিল, শুধু খাওয়াবাবদ মাসিক ৮ টাকা দেওয়া লাগত। হোস্টেল ছিল





বুড়িগঙ্গার কাছেই। তখন নদীর পানি অত্যন্ত স্বচ্ছ ছিল, আমরা দল বেঁধে গোসল করতাম, সাঁতার কাটতাম। সৈয়দ ইবনে রহমত: ঢাকায় তখন পরিচিত কেউ ছিলেন? অধ্যাপক আবদুল গফুর: আবদুর রহমান নামের এক লোক ছিলেন আমাদের এলাকার। তিনি লালবাগে থাকতেন। ঢাকায় এসে প্রথমে তার বাসাতেই উঠেছিলাম। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর হোস্টেলে চলে আসি।
আর ফরিদপুর ময়েজ উদ্দিন হাই মাদরাসায় আমার এক বছরের সিনিয়র ছিলেন, নাম এনামুল হক। তিনিও ঢাকায় গভর্নমেন্ট ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। আমি আসার পর এনামুল হক খুব খুশি হয়েছিলেন। সবার সাথে গর্বের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিতেন, আর বলতেন, এই দেখো, আমার এলাকার আবদুল গফুর, অত্যন্ত মেধাবী স্টুডেন্ট, ম্যাট্রিকুলেশনে স্ট্যান্ড করা ছাত্র। সৈয়দ ইবনে রহমত: পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত হলেন কখন? অধ্যাপক আবদুল গফুর: পাকিস্তান আন্দোলনের





সাথে যুক্ত হয়েছিলাম আরো আগেই। ফরিদপুর ময়েজ উদ্দিন হাই মাদরাসায় থাকতেই পাকিস্তান আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি। মাদরাসায় আমার সিনিয়র ছাত্র ছিলেন হাফেজ মতিউর রহমান, এনামুল হক প্রমুখ। তারা পাকিস্তান আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন।
তারা আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মাদরাসার হোস্টেলে থাকতাম, মেধাবী স্টুডেন্ট হিসেবে আমার কোনো খরচ দিতে হতো না। সেখানেই তাদের সাথে পাকিস্তান আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি। নিয়মিত মিছিল-মিটিংয়ে যোগ দিতাম। ফরিদপুরের হালিমা জুনিয়র গার্লস মাদরাসায় একবার পাকিস্তান আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিয়ে দুই সপ্তাহের একটা ক্যাম্প হয়েছিল। সেখানে পাকিস্তান আন্দোলন কেন প্রয়োজন সে সম্পর্কে নেতৃবৃন্দ আমাদের লেকচার দিতেন। বিশেষ করে, বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি আবুল হাশিম প্রতিদিন সন্ধ্যায় বক্তৃতা করতেন। তার তীক্ষ্ণ যুক্তিযুক্ত বক্তব্য শুনে শুনেই আমরা তখন পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ি। সৈয়দ ইবনে রহমত: পাকিস্তান আন্দোলনের সময় তো





সিলেটেও গিয়েছিলেন? অধ্যাপক আবদুল গফুর: হ্যাঁ, সিলেট রেফারেন্ডামের সময় সেখানে গিয়েছিলাম। আমার চাচাত ভাই ইসাহাক আলীর সাথে আমি গিয়েছিলাম। মুসলিম লীগের আরো অনেক নেতাকর্মীও গিয়েছিলেন। আমাদের কাজ ছিল,
সেখানকার মুসলমানরা যেন পাকিস্তানের সাথে থাকার ব্যাপারে ভোট দেয় সে জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করা। দুই দিন ব্যাপী গণভোট হয়েছিল, কিন্তু আমরা যে এলাকায় প্রচার চালিয়েছিলাম সেটা শেষ পর্যন্ত ইন্ডিয়াতেই পড়েছিল। সৈয়দ ইবনে রহমত: তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট কী ছিল? কারা এর সাথে জড়িত ছিলেন? অধ্যাপক আবদুল গফুর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম সাহেব। পাকিস্তান আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করার আগেই তিনি পাকিস্তানের কালচারাল মুভমেন্ট কী হবে সেটা নিয়ে ভাবছিলেন।
সমমনা কয়েকজনকে নিয়ে একটি ইসলামি বিপ্লবী কালচারাল অর্গানাইজেশনের পরিকল্পনা করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর ১ সেপ্টেম্বর আবুল কাসেম সাহেব সৈয়দ নজরুল ইসলাম (পরে মুজিনগর সরকারের অ্যাক্টিং প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন), শামসুল আলম এবং ফজলুর রহমান ভূঁইয়াকে (১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি





হয়েছিলেন) নিয়ে ‘পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস’ গঠন করেন।
পাকিস্তানের জাতীয় সাংস্কৃতি বিকাশের জন্যই মূলত এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা হয়। আবুল কাসেম সাহেব ছিলেন ফাউন্ডার সেক্রেটারি। শুরুতে তমদ্দুন মজলিসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কোনো পদ ছিল না, সেক্রেটারি জেনারেলই ছিলেন সংগঠনের প্রধান ব্যক্তি।
সৈয়দ ইবনে রহমত: ভাষা আন্দোলন বা তমদ্দুন মজলিসের সাথে যুক্ত হলেন কীভাবে? অধ্যাপক আবদুল গফুর: সিলেট রেফারেন্ডমের সময় আবুল কাসেম সাহেবেরও সেখানে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অসুস্থ থাকায় তিনি যেতে পারেননি। কাসেম সাহেব যেতে না পারলেও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বলে দিয়েছিলেন, সিলেটে যদি আমাদের চিন্তাধারার কাউকে পান তাহলে আমার কাছে নিয়ে আসবেন। সেখান থেকে কথাশিল্পী শাহেদ আলীকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম নিয়ে এসেছিলেন আবুল কাসেম সাহেবের কাছে। কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় তখন গল্প লিখতেন শাহেদ আলী। সেসব গল্প পড়ে আমি তার ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ১৯৪৭ সালে আমি আইএ পাস করি, তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্সে ভর্তি হই। জায়গীর থাকি ভাটি মসজিদের কাছে। আমার জায়গীর বাড়ির কাছেই আজিমপুর রোডের ১৯ নম্বর বাসাটি ছিল আবুল কাসেম সাহেবের। সেই





বাসাতেই উঠেছিলেন শাহেদ আলী। ১৯৪৮ সালের কথা, একদিন দেখি চায়ের দোকানে শাহেদ আলী বসে আছেন; আমি চা খাই না, শুধু উনার কাছে যাওয়ার জন্যই দোকানে গিয়ে বসলাম। সেখানেই পরিচিত হই, তারপর থেকে মাঝে মাঝেই কথা হতো। একদিন তার সাথে কাসেম সাহেবের বাসাতেও যাই। সেখানে তখন নিয়মিত যেতেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, কাজী মোতাহের হোসেনসহ আরো অনেকেই। এভাবেই কখন যে তমদ্দুন মজলিসের সাথে জড়িয়ে যাই, নিজেও বুঝতে পারিনি।
সৈয়দ ইবনে রহমত: তমদ্দুন মজলিসের সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ কীভাবে শুরু হলো? অধ্যাপক আবদুল গফুর: কালচারাল সংগঠন হলেও শুরু থেকেই বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সোচ্চার হয় তমদ্দুন মজলিস। কিন্তু সদ্য পাকিস্তান পেয়ে অধিকাংশ মানুষ এতটাই আবেগপ্রবণ ছিল যে, রাষ্ট্রভাষার দাবির বিষয়ে তাদের তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। বরং, অনেক ক্ষেত্রে তারা উল্টো রাষ্ট্রভাষার দাবিকে সন্দেহের চোখে দেখত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাধাও দিত। একারণেই ভাষার দাবিতে জনসচেতনতা ও জনমত গঠনে আবুল কাসেম সাহেবকে খুবই পরিশ্রম করতে হচ্ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও বিভিন্ন হলে নিয়মিত সাহিত্য সভা-সেমিনার করে ভাষার দাবিতে বক্তৃতা দিতেন। অনেক ছাত্র-শিক্ষক সেখানে যোদ দিতেন। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীসহ আরো অনেকেই তখন এসব সভা-সেমিনারে বক্তৃতা করেছেন। ভাষার দাবিতে তমদ্দুন মজলিস কখনো প্রতিদিন, কখনো প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো প্রোগ্রাম করছিল, প্রোগ্রামের নিউজ বিভিন্ন পত্রিকাতেও পাঠানো হতো। কিন্তু বেশিরভাগ নিউজই ছাপা হতো না। কোনো কোনো পত্রিকাতে আবার ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করেও লেখা ছাপা হতো।





এসব দেখেই আবুল কাসেম সাহেব চিন্তা করলেন, আমাদের চিন্তাধারাকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হলে নিজেদের একটি পত্রিকা লাগবে। তারপর ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে প্রকাশ শুরু হলো তমদ্দুন মজলিসের নিজস্ব পত্রিকা সাপ্তাহিক সৈনিক। এর প্রকাশক ছিলেন আবুল কাসেম সাহেব, প্রধান সম্পাদক ছিলেন শাহেদ আলী, অন্যতম সম্পাদক ছিলেন এনামুল হক, আর আমি ও সানাউল্লাহ নূরী ছিলাম সহকারী সম্পাদক।
পরে শাহেদ আলী চাকরি নিয়ে চলে যান বগুড়া আজিজুল হক কলেজে এবং এনামুল হক সাহেবও সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। তারা চলে যাওয়ার পর আমিই সম্পাদক হই। ৫২ সালের চূড়ান্ত আন্দোলনের সময় আমার সম্পাদনাতেই প্রকাশিত হতো সৈনিক পত্রিকা। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা নিয়ে ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি পর পর তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল সৈনিক পত্রিকার। এর একটা অফিস ছিল ৪৮ নম্বর কাপ্তান বাজারে আর আরেকটা অফিস ছিল ১৯ নম্বর আজিমপুর রোড আবুল কাসেম সাহেবের বাসায়।
শুরুতে এটা বিভিন্ন প্রেস থেকে ছাপা হতো, বছর দুই পরে নিজেদের একটা প্রেস হয়। কবি শামসুর রাহমান তখন ছাত্র। তার লেখাসহ সেসময়ের প্রায় সকল কবি-সাহিত্যিকের লেখা ছাপা হতো সৈনিক পত্রিকায়। সৈয়দ ইবনে রহমত: আপনার লেখালেখি কীভাবে শুরু হয়েছিল? অধ্যাপক আবদুল গফুর: ফরিদপুর মাদরাসায় থাকতেই লেখালেখি করতাম। সেসব লেখা কোথাও প্রকাশ হয়েছিল কিনা এখন সেটা মনে নেই। ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর প্রকাশিত সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই





আমার একটা লেখা ছাপা হয়েছিল। সম্ভবত লেখার বিষয় ছিল ‘পাকিস্তানে গণতন্ত্র’। আমি লেখাটা লিখে শাহেদ আলী সাহেবের হাতে দিয়েছিলাম; ভাবছিলাম, কাঁচা হাতের লেখা হয়তো ছাপা হবে না। কিন্তু দেখলাম, শাহেদ আলী সাহেব মাত্র কয়েকটা শব্দ এদিক সেদিক করে পুরো লেখাটাই ছাপতে দিয়ে দিলেন। বাহবা দিয়ে বললেন, অত্যন্ত ভালো হয়েছে। লেখা চালিয়ে যেতে হবে।
সৈয়দ ইবনে রহমত: ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?’ পুস্তিকা সম্পর্কে কিছু বলেন। অধ্যাপক আবদুল গফুর: পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে সেটা নিয়ে তখনো স্থির সিদ্ধান্ত হয়নি। এর মধ্যেই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি জিয়া উদ্দিন দাবি করলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। তার পক্ষে আরো অনেকেই মত ব্যক্ত করেছিলেন। পক্ষান্তরে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বিভিন্ন পত্রিকায় লিখে এবং সাহিত্য সভা-সেমিনারে বক্তৃতা করে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তার পক্ষেও অনেকে মতামত দিচ্ছিলেন। কিন্তু সেটার সমাধান হওয়ার আগেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট।
আগেই বলেছি, ১ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস গঠিত হয়। ইতোমধ্যে ১৫ সেপ্টেম্বর মজলিসের পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?’ এতে তিনজনের লেখা স্থান পেয়েছিল। মজলিসের পক্ষ থেকে ‘আমাদের প্রস্তাব’ শিরোনামে লিখেছিলেন আবুল কাসেম সাহেব। আর লিখেছিলেন কাজী মোতাহের হোসেন এবং রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ। কিন্তু তমদ্দুন মজলিসের দাবি সত্ত্বেও দেখা গেলো, সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজে ইংরেজির পাশাপাশি শুধু উর্দুর ব্যবহার শুরু করে দেওয়া হলো। এই প্রেক্ষাপটে মজলিস ও ছাত্রদের আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া উপায় থাকে না। সৈয়দ ইবনে রহমত: তখন কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়? অধ্যাপক আবদুল গফুর: সাহিত্য সভা-সেমিনার, হ্যান্ডবিল বিলি এসব কার্যক্রম আগে থেকেই চলছিল, যা জোরদার করা হয়। মজলিসের উদ্যোগে ৪৭ সালেই দল মত নির্বিশেষে সকলকে ভাষা আন্দোলনের সাথ যুক্ত করার জন্য একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর আহবায়ক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রির লেকচারার নূরুল হক ভুঁইয়া। এরমধ্যে কয়েক সপ্তাহ চেষ্টা করে আবুল কাসেম সাহেব বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে কয়েক হাজার বিশিষ্ট লোকের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে সরকারের কাছে পেশ করেছিলেন। অন্যদিকে ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদের বৈঠকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সংসদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাতে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দানের দাবি করেন। কিন্তু সে দাবি নাকচ হয়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদকে সম্প্রসারিত করা হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি। এটার আহবায়ক করা হয় শামসুল আলমকে।
তিনি তমদ্দুন মজলিস এবং মুসলিম ছাত্রলীগেরও মেম্বার ছিলেন। এই কমিটির উদ্যোগেই ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পূর্বপাকিস্তানে হরতাল আহবান করা হয়। হরতালে পিকেটিংয়ের সময় ছাত্র এবং পুলিশের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।





এতে আবুল কাসেম সাহেবসহ অনেকে আহত হন। পুলিশ অলি আহাদ, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেককে আটক করে। এরপর থেকে প্রতিদিনই মিছিল-মিটিং চলতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে পূর্বপাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ১৫ মার্চ সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করে তাদের সব দাবি মেনে নিয়ে ৮ দফা চুক্তি করেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উপস্থিতিতে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে তিনি উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেন। এরপর ২৪ মার্চ কার্জন হলে অনুষ্ঠিত কনভোকেশনে বক্তৃতা করেন, সেখানেও তিনি উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। সেখানে ছাত্রদের মধ্যে অনেকে এর প্রতিবাদ করেন। সৈয়দ ইবনে রহমত: ২১ ফেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপট তৈরি হলো কীভাবে? অধ্যাপক আবদুল গফুর: জিন্নাহ সাহেব ও লিয়াকত আলী খান মারা যাওয়ার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি ৪৮ সালে নিজের করা চুক্তির কথা ভুলে গেলেন।
১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে পশ্চিমা নেতাদের খুশি করতে পল্টনের একজনসভায় বক্তৃতায় বললেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ তার এই বক্তব্যের পরেই ফুঁসে উঠে পূর্বপাকিস্তান। তৃতীয় বারের মতো গঠন করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি তৎকালীন বিভিন্ন সংগঠন থেকে দুই জন করে নিয়ে এই পরিষদ গঠিত হয়। তমদ্দুন মজলিস থেকে আবুল কাসেম সাহেব এবং আমি ছিলাম এর মেম্বার। এর আহবায়ক করা হয়েছিল কাজী গোলাম মাহবুবকে। এই সংগ্রাম পরিষদের মিটিংয়েই সিদ্ধান্ত হয় ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল ও অন্যান্য কর্মসূচি পালন করা হবে, আর সে মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করেছিলেন মওলানা ভাসানী। ২০ ফেব্রুয়ারি দুপুরের দিকে রেডিওতে ঘোষণা করা হলো: ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এর ফলে সেদিন সন্ধ্যায় ৯৪, নবাবপুর রোডে আওয়ামী মুসলিম লীগের অফিসে সংগ্রাম পরিষদের এক মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়।




